প্রেক্ষিত আলোচনা
আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ মহিমান্বিত কুরআনুল কারীমের মর্মবাণীর তাৎপর্য, আয়াতের গবেষণা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা সাধারণের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ আমাদের বেড়ে ওঠা, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রাত্যহিক জীবনের কর্মব্যস্ততাসহ নানা সীমাবদ্ধতার দরুন কুরআন নিয়ে আমাদের গভীর অধ্যয়ন এবং গবেষণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন যে, তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না? না কি তাদের অন্তরে তালা রয়েছে’ (৪৭:২৪) সুতরাং উদ্ধৃত এ আয়াতটি প্রতিপালন করা প্রতিটি মুমিনের জন্য বাধ্যতামূলক ফরমানে পরিণত হয়েছে। বিশেষত সমাজের উচ্চশিক্ষিত মুমিন ব্যক্তির উপর কুরআন গবেষণার অধিকরত দায়িত্ব বর্তায়। কুরআন প্রাপ্তির চৌদ্দশত বছরের অধিককাল পাড় হতে চলল। সময়ের পরিক্রমা, জাতির উত্থান পতন, নয়া সভ্যতায় আদর্শিক চেতনা বহুমাত্রিক রূপ বদল। মুসলিম উম্মাহরও আদর্শিক চেতনা হাজার মতবাদে বিভক্ত হয়ে পরেছে। ফলশ্রুতিতে মুসলিম উম্মাহর অতীত গৌরব তলানীতে ঠেকেছে। এর মূল কারণ কুরআনের নূর থেকে বহুদূর সরে যাওয়া। এখন নিবিড়ভাবে গবেষণার মাধ্যমে কুরআনের কাছে আমাদের ফিরে আসতে হবে। অত্যন্ত দুরূহ হবে এ কাজটি। কুরআন নিয়ে লিখতে অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে যান, এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। আমাদের আলেম সমাজ শতধা বিভক্ত। একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার মানসিকতা কদাচিৎ দেখা যায়। সেই বিভাজন দিন দিন অনেক কুৎসিত হয়ে উঠেছে। অথচ যুক্তি সহকারে একটি বিষয় ভিন্নমত পোষণ করা বাগ্মিতা যা জ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করে। তাদেরকে আমরা তার্কিক, যুক্তিবাদী বলে থাকি। তাদের শ্রুতিমধুর ভাষণের মাধুর্য স¦ত:ই বিবেককে জাগ্রত করে।তাই মতের ভিন্নতা দোষের নয়, দোষের হলো ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি চরম নীতি আর কঠোর মনোভাব পোষণ করা।
এ লেখার পটভূমি তৈরিতে প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক সত্যের কিছুটা অবতারণা করতে হচ্ছে। সম্মানীয় পাঠকবৃন্দ অবগত আছেন, ব্রিটিশ শাসককুল শুরু থেকেই পরাজিত শক্তি হিসেবে মুসলিমদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন। মুসলিম শক্তি যাতে অতীত গৌরবগাঁথা ইতিহাসে ভর করে তাদের হৃতরাজ্য পুনঃ:রুদ্ধারের নেশায় মাথা চাড়া দিয়ে কখনও দাঁড়াতে না পারে তার ফন্দিফিকির আঁটতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং স্বত:প্রণোদিত হয়ে ১৭৮০ খ্রি: প্রথমে আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। অত:পর বিভিন্ন রকমের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন ধর্ম মতবাদ আহম্মাদীয়া সম্প্রদায়সহ নানা ধর্মাবলম্বীর উদ্ভব ঘটায়। ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে মুসলিম সমাজে তখন দরসে একটি পাঠ্যক্রম বিদ্যমান ছিল।এ শিক্ষা কার্যক্রমে কেবল ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষাই বাদ দেয়া হত। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করতে হচ্ছে যে ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়েছিল ৭১২ খ্রি: সিন্ধু বিজয়ের মধ্যদিয়ে । সেই থেকে ১৭৫৭খ্রি: পর্যন্ত ভারত মুসলিম সুলতান দ্বারাই শাসিত হয়েছিল। তাদের যেমন সফলতা ছিল, ব্যর্থতাও কম ছিল না। অস্বীকার করা যায় না যে তাদের বড় সফলতা ছিল শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী গঠন, যারা বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয় মুসলিম শাসকগণ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেন নি। এত দীর্ঘ সময়ে তাদের নামের পার্শ্বে প্রতিরক্ষা ব্যতীত উল্লেযোগ্য সফলতা ছিল দেওয়ানি আম, দেওয়ানী খাস, ময়ূর সিংহাসন, কুতুবমিনার, তাজমহল এমন আরো কিছু ইট পাথরের কীর্তিগুলো। জৌলুস, সম্পদ আর বিত্ত বৈভবেই তারা প্রধান লক্ষ্য বানিয়ে ছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় নয়। তাদের হয়ত জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চার বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা বা উৎসাহ ছিল না। এর দায়ভার তৎকালীন মুসলিম শাসকদের হলেও তার ঐতিহাসিক ফল হয় সুদূরপ্রসারী। ভারতবর্র্ষের অকথিত ইতিহাসের পরিণতি হাজার বছরের মুসলিম শাসনের চির অবসান। ত্রিধা বিভক্ত মুসলিম জাতিকে দু’শো বছর ব্রিটিশদের গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে রাসুল (স:) এর ওফাতের ১৫০ বছর পরে আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠার মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে খলিফা হারুন -অর-রশিদ ৭৮৭ খ্রি বাইতুল হিকমা ”প্রতিষ্ঠা করেন। বাইতুল হিকমার জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় এমন কোন শাখা ছিল না যার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়নি। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল বিভাগে একই সময় এমন বিস্ময়কর সাফল্য পৃথিবীর ইতিহাসে ছিল বিরল ঘটনা। বায়তুল হিকমার গবেষণা লব্ধ জ্ঞান বহু ভাষায় অনুবাদ করে যেমন তারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি বহি:বিশ্বের সঞ্চিত জ্ঞান আহরণ করে তারা নিজ সংগ্রহশালায় সযতনে সংরক্ষণ করে ছিলেন। মানব সভ্যতা বাইতুল হিকমার জ্ঞান ভান্ডারের কাছে চিরঋণী হয়ে রইল। ঠিক এর আদলে মিশরে ফাতেমীয় শাসন প্রতিষ্ঠার মাত্র ৮০ বছরের মধ্যে তারা দারুল হিকমা নামক জ্ঞান বিজ্ঞানের গবেষণাগার গড়ে তুলেছিলেন। অপরদিকে তাদের রাষ্ট্রের আর্থ- সামাজিক সমৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও ছিল আকাশচুম্বী সাফল্য।এ গৌরবগাঁথা অতীত আমরা কখনও বক্ষে ধারণ করি না। ঐ আলোকিত যুগে পশ্চিমারা ছিল চরমভাবে পশ্চাৎপদ অথচ তাদের নিজেদের দুর্বল অতীতকে ঘিরে তারা মধ্যযুগকে নিয়ে ঐতিহাসিক মিথ্যাচারে লিপ্ত। প্রতিবাদে অক্ষম মুসলিম উম্মাহ আজও এ মিথ্যাচারকে নীরবে সয়ে যাচ্ছে আবার প্রগতিশীলদের কেউ কেউ তাদের দোসরদের ঐতিহাসিক ঐ মিথ্যাচারকে সানন্দে সত্যায়ন দিচ্ছেন।
ব্রিটিশ ভারতে প্রতারণা মূলক শিক্ষানীতি আলোচনায় আবার ফিরে আসছি। আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকালীন কলকাতা কিংবা সমগ্র ভারতের কোথাও ইংরেজ কর্তৃক আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ দিন পরে ১৮০০খ্রি: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং ১৮১৭ খ্রি: রাজা রামমোহন রায় ইংরেজদের সহায়তায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো। কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তেমনটি ছিল না, তারা চেয়েছিল পরাজিত শক্তিকে জ্যান্ত মরা করে টিকিয়ে রাখতে। এ উদ্দেশ্যকে সফল করার লক্ষ্যে ইংরেজ প্রায় দেড়শত বছর তাদের মত করে বাস্তবতা বিবর্জিত পাঠ্যক্রম চালু করেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী (১৮৫০ সালে মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদ সৃষ্টি করা হয়। তৎপূর্বে মাদ্রাসা কমিটির সচিব দ্বারা মাদ্রাসা পরিচালনা করা হতো এবং ইউরোপিয়ানরাই সচিব নিযুক্ত হতেন।) আশ্চর্যের বিষয়, এতো দীর্ঘ সময় কোন মুসলিম ব্যক্তিকে তারা মাদ্রাসা কমিটির সচিব বা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেননি অথচ প্রতিষ্ঠানটির সকল ছাত্রই মুসলিম। অপরদিকে হিন্দু কলেজ, যা পরবর্তীতে, প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয়, এর অধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল পদ হিন্দু সমাজ দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তর বিভক্তি আর অধিকার হননে ব্রিটিশ সুকৌশলে মুসলিম সমাজকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করে ফেলতে শুরু করেন। দরসে নিজামি এবং কওমি পদ্ধতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূলধারাগণ, এর বিকল্প হিসেবে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আলীয়া শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন আই ওয়াস হিসেবে।প্রকৃতপক্ষে মাদ্রাসার শিক্ষাকে তারা বাস্তব জীবন থেকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ আখেরাতমুখী করে গড়তে চেয়েছিলেন।ব্রিটিশদের এতসব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় মুসলিম নেতারা অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। সুদীর্ঘ সময় ধরে ইংরেজরা মুসলিম জাতির প্রতি যে বৈষম্য, অধিকার হরণে মহাযজ্ঞে মেতেছিল মুসলমান নেতৃবৃন্দ তার বিরুদ্ধে সময়োপযোগী কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থাই গড়তে পারেনি।তাদের প্রতিবাদী মনোভাব পরাজিত মানসিকতায় রূপ নেয় যা কালক্রমে মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়।
প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, অত:পর হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে হিন্দুসমাজ দ্রুত আধুনিক শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনে যোগ্যতা অর্জন করেন। ফলশ্রুতিতে হিন্দু সমাজের আর্থ সামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে আর আধুনিক শিক্ষা না থাকায় মুসলিম সমাজ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে। বাস্তবতার কষাঘাতে মুসলিম সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সকল বাধা আর সমালোচনা উপেক্ষা করে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ আগ্রহী হয়ে উঠেন।ক্রমাগতভাবে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের ফলে তারা সরকারি চাকুরি নিয়ে সমাজের মূলধারায় শামিল হতে শুরু করেন।যারা আসতে চাননি কিংবা পারেননি তারা এ পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে মুসলিম শক্তি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। আজ প্রায় আড়াইশত বছর হতে চললো, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নতি হয়েছে বটে তবে তা আংশিক, সার্বিক নয় এবং মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এখনও বহুদূরে। কর্মজীবনে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের জন্য নির্ধারিত-মসজিদ আর মাদ্রাসার খেদমত। সমাজে তাদের খুব বেশি প্রয়োজন- জানাজার ইমামতির দায়িত্ব পালনে।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ অতীতের মত নয়। মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যুগপৎ দ্বিনি শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষায় তাদের শিক্ষার্থীদেরকে আলোকিত করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে অধিক ভূমিকা পালনের যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে বস্তুনিষ্ঠ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। আজও দেশে-বিদেশে বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থায় দেশ ও জাতির বিপুল অর্থে অপচয়ই হয় না, এতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হয়। মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন যাবৎ মাদ্রাসা আর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা পাশাপাশি বিদ্যমান থাকায় পরস্পরের চিন্তা চেতনায় দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে।আস্থাহীনতার দরুন পরস্পরকে মান্যতা না দেবার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যার প্রমাণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে যেভাবে ইসলামের দাওয়াতি কাজের আনজাম দেয়া হচ্ছে,তা সিরাতে রাসুল (স:)এর মৌলিক আকীদার অনুকরণে, অনুসরণে যে হচ্ছে না এ মর্মে অনেকেরই মন্তব্য শোনা যায়। তাদের মূল বক্তব্য ইসলামের ইতিহাস, সাহাবা চরিত, শরীয়াহর মাশালা মাশায়েল, পর্দা, তাসবিহ জিকরের মানহাজ বাতলে দেয়া। বিশেষ করে কবরের আজাব, কিয়ামত, হাশর, জান্নাত আর জাহান্নামের আবেগময় বর্ণনা শ্রোতাদের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যায়। তারা হাসান, কাঁদানো; নিজেরাও কখনো কখনো কাঁদেন।এমন পরিবেশে তাদের ইমানের দৃঢ়তা বেড়ে যায়।আবার এমন বক্তা আছেন যারা দুর্বল যুক্তি, হাল জামানার রুচি-বহির্ভূত গান, এমনকি কেউ কেউ যৌন আবেদনপূর্ণ বয়ানের সাহায্যে সরলমনা শ্রোতাদের আবেগ উসকে দিতে কসুর করেন না।তাঁরা রুগ্ণ দেহ, ভগ্নহৃদয়,অনাহারী-অর্ধাহারী মানুষদেরকে দোযগের কঠিন শাস্তির বয়ান শুনিয়ে মনোবল আরো দুর্বল করে দেন, আবার বেহেশতের সর্বসুখের স্বপ্ন দেখিয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন। এভাবেই কুরআনের সিংহভাগ বিষয়বস্তু মননশীল ও হৃদয়গ্রাহী আলোচনার বাইরেই থেকে যায় শুধু তাই নয় এতে ধর্মের ভাব গাম্ভীর্য পরিবেশ এবং পবিত্রতার অনেক খানি ব্যত্যয় ঘটে থাকে।
একটি সমাজে বহু শ্রেণি, পেশার মানুষ বাস করেন।পরস্পরের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা সুনাগরিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এক একজন এক এক বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করে থাকেন। যিনি ডাক্তার তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার আশা করেন না। আবার পদার্থবিজ্ঞানীও সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার আশা রাখেন না। মানবজীবনের সকল বিষয়ের বিশেষ জ্ঞান একজনের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। কুরআনুল কারিমে অন্তত ১১%––১৫% বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াত রয়েছে। আছে অর্থ-ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-প্রশাসন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা’, মনোজাগতিক শিক্ষা, সাহিত্য, জীবন, দর্শন নবী-রাসুলগণ এবং তাঁদের অনুসারীদের জীবনালেখ্য, অবিশ্বাসীগণের পরিণতির কাহিনি, কিয়ামত, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম, শরীয়ার বিধিবিধান, মানব সৃষ্টির রহস্য ইত্যাদি। বর্তমানে মুক্তবাজার, লাগামহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ নিয়ে নাস্তিক্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। এই জটিল প্রেক্ষাপটে কেবল ইসলামের ইতিহাস, কবরের আজাব, জান্নাত, জাহান্নামের বয়ান দিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ইসলামের মাহাত্ম্য উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না। যাঁরাই মানুষের সামনে ইসলামের উপর বক্তব্য রাখবেন, তাঁদের বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, অর্থব্যবস্থা বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। এই বাস্তবতায় মানুষের কাছে ইসলামকে ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন করার মহৎ দায়িত্ব মুসলিম উম্মাহর সব অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের আল্লাহ প্রাণ আগ্রহী ও যোগ্য ব্যক্তির উপর বর্তায়। এখন সময়ের দাবি, সকল বিভেদ ভুলে সকল উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা। দরকার ইসলামের স্বর্ণযুগের বাইতুল হিকমা, দারুল হিকমার অনুকরণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কোনো স্বতন্ত্র সংস্থা গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি যোগ্যতাসম্পন্ন আগ্রহী সিনিয়র সিটিজেনের সম্মিলিত প্রয়াসে আর একটি স্বতন্ত্র গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা, যাঁরা ইসলাম আর আধুনিক জ্ঞানের সেতুবন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হবেন। মুসলিম উম্মাহর যারা যে বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন তাদের অর্জিত জ্ঞানের যে অংশটুকু ইসলামের খেদমতে এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিবেদন করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা। এমন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হলে দেশ ও জাতি তথা বিশ্ববাসী উপকৃত হবেন আর ইসলামের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হবে ইনশাআল্লাহ।
আবু জিসান
০৭.০৬.২০২৩